যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশকে নতুন ভাবে গড়ে তোলার সময় নিজের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে লালন করা এবং সেগুলো চর্চার পথ অব্যাহত রেখে পাশাপাশি এগিয়ে চলা খুব বেশি সহজ নয়। কেননা একদিকে থাকে নতুন ভাবে নতুন নিয়মে দেশ গঠনের গুরু দায়িত্ব, অন্য দিকে সেই নিজ দেশে নিজের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে সেদিকেও বেশ শক্তপোক্ত ভাবে খেয়াল রাখতে হয়। আর ১৯৭১ সালের পর স্বাধীন বাংলাদেশে সংস্কৃতি রক্ষার এই গুরু দায়িত্বটি নিজের কাধে তুলে নেয় এদেশের স্বাধীন চলচ্চিত্র অঙ্গন।
তাই স্বাধীন হওয়ার পর, এদেশের নির্মাতারা চলচ্চিত্র নির্মাণে পুরো দমে নিয়োজিত হন, তাদের বেশির ভাগ গল্পই ছিল মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক। এর পিছনে প্রধানত দুটি উদ্দেশ্য ছিল, প্রথমত মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী গল্প আকারে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করা এবং সেই সাথে সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার দ্বার উন্মোচন করা। আর ঠিক এ কারনেই স্বাধীন হওয়ার ঠিক এ সপ্তাহের মাঝে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র “ওরা ১১ জন” নিয়ে কাজ শুরু করেন নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলাম।
ওরা ১১ জন! স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র! এ চলচ্চিত্রে পুরো মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকে সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে এদেশের দামাল ছেলেরা কিভাবে নিজেদের জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছে তার সুন্দর উপস্থাপন এখানে দেখানো হয়। পুরো চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের সেই ভয়ানক পরিস্থিতি ও অসংখ্য আত্মত্যাগের একটি প্রতিচ্ছবি। তাই শুধু সেই সময়ের নয়, বর্তমান সময়েও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রগুলোর শীর্ষে অবস্থান এই চলচ্চিত্রটির।
এই নামের চলচ্চিত্র তৈরির পিছনেও ছিল ঐতিহাসিক কারণ। মুক্তিযুদ্ধের ১১ দফা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট আর ১১ টি সেক্টর ও সেখানকার মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মিলিয়ে এই চলচ্চিত্রটির নাম রাখা হয় “ওরা ১১ জন”! শুধু তাই নয়, পুরো ছবিতেই মুক্তিযুদ্ধের নানা উপকরণ সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফাকে স্মরণ করিয়ে দিতে ছবির শুরুতেই যখন ওরা ১১ জন নামটি পর্দায় ভেসে ওঠে, তখন কামানের ছয়টি গোলা ছোড়ার শব্দ ব্যবহার করা হয়। সেই সাথে এই ছবিতে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের দৃশ্য দেখানো হয়। যেখানে ভাষণের কিছু গুরুত্বপূর্ণ লাইন হুবুহু তুলে ধরা হয়েছে। দেশাত্মবোধক নানা গান ও নানা মর্মস্পর্শী চিত্রও রয়েছে এতে।
এ চলচ্চিত্রটিতে পাক প্রেসিডেন্ট ইহাহিয়া খানের ঘোষণা, ৭ ই মার্চের ভাষণ, ২৫ মার্চের ভয়ংকর সেই কালরাত্রী প্রত্যেকটি ঘটনা গল্প আকারে সুন্দর ভাবে চিত্রায়িত হয়েছে৷ সেই রাতের ধ্বংসযজ্ঞের পর, কিভাবে ১১ জন সাহসী যোদ্ধা তাদের জাতি ধর্ম বর্ণ ভুলে গিয়ে দেশের জন্য ঝাপিয়ে পড়েন তারই গল্প এ চলচ্চিত্রে সুন্দর ভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এ চলচ্চিত্রে মূলত ১১ জনের একটি গেরিলা বাহিনীর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের দৃশ্য ও গল্প তুলে ধরা হয় যা এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের গেরিলা আক্রমণের চিত্রটি রূপক আকারে আমাদের সামনে তুলে ধরে। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে নারীদের ভূমিকা ও বীরঙ্গনাদের আত্মত্যাগ ও এই চলচ্চিত্রে ফুটিয়ে তোলা হয়। কিভাবে এদেশের নারী পুরুষ তাদের নিজেদের সকল স্বপ্ন সকল কিছুকে নিজের দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকার করে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পরে তা এখানে চমৎকারভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
এই ছবিতে প্রধান এগার জন যুবকের চরিত্রে অভিনয় করেছেন খসরু, মুরাদ, বেবী, মনজু, সিদ্দিক জামাল নান্টু, আবু, আলতাফ, কাজী ফিরোজ রশীদ, অলিন, আতা ও হেলাল। এছাড়াও অভিনয় করেছিলেন রাজ্জাক, শাবানা, নূতন, সৈয়দ হাসান ইমাম, রওশন জামিল, খলিল, মেহফুজ সহ আরো অনেক। ছবির বেশির ভাগ শুটিং হয় জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্টে। পুরো ছবি তৈরি করতে খরচ হয় প্রায় পাঁচ লাখ টাকা। জানা যায়, ছবি মুক্তির প্রথম সপ্তাহেই খরচের টাকা উঠে এসেছিল।
“ওরা ১১ জন” মুক্তিযুদ্ধের একটি ছোটো সারসংক্ষেপ। এটি মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক প্রথম পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র হওয়ার পাশাপাশি এটি ভবিষ্যত প্রজন্ম ও আমাদের বর্তমান প্রজন্মের জন্য একটি প্রামাণ্য দলিল। এই চলচ্চিত্রটি দেশ প্রেমের একটি অনন্য উদাহরণ। সেই সাথে এটি বর্তমান চলচ্চিত্র নির্মাতাদের জন্যও একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

কনক চাঁপা চাকমা: বাংলাদেশের চিত্রশিল্পের নারী রত্ন
কনক চাঁপা চাকমা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চিত্রকলায় এক বিখ্যাত নাম। তিনি তাঁর চিত্রকলায় মূলত ফুটিয়ে তোলেন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবন। তুলে ধরেন