অপরাজেয় কথাশিল্পী নামে পরিচিত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক কালজয়ী লেখক। তিনি কেবল লেখকই ছিলেন না, একাধারে ছিলেন জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক এবং গল্পকারও। তিনি ১৮৭৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত প্রেসিডেন্সি বিভাগের হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মতিলাল চট্টোপাধ্যায় এবং মাতার নাম ভুবনমোহিনী দেবী। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর ডাকনাম ছিলো ন্যাড়া। তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শুরু ঘটে পাঁচ বছর বয়সে দেবানন্দপুরের প্যারী পণ্ডিতের পাঠশালায়। বছর তিনেক সেখানে অধ্যয়নরত ছিলেন তিনি।
এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম নেয়া শরৎচন্দ্রের ছেলেবেলার বেশিরভাগটাই কেটেছে ভাগলপুরে মামাবাড়িতে। পরবর্তীতে ভাগলপুর জিলা স্কুলে ভর্তি হন ১৮৮৭ সালে। কিন্তু ১৮৮৯ সালে পিতার ডিহিরির চাকরি চলে গেলে পুরো পরিবার দেবানন্দপুরে ফিরে আসে। তিনি পড়াশোনা শুরু করেন হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুলে। কিন্তু ১৮৯২ সালে স্কুল ফি দিতে না পারায় তাঁকে এ স্কুল ত্যাগ করতে হয়। এসময় থেকেই তাঁর কাব্যপ্রতিভার কলি ফুটতে শুরু করে। তিনি ‘কাশীনাথ’ এবং ‘ব্রহ্মদৈত্য’ নামে দুটো গল্প লেখেন। পরবর্তীতে এন্ট্রান্স পাশ করলেও এফ.এ. পরীক্ষার জন্য বসতে পারেননি টাকার অভাবে পড়াশোনায় যথেষ্ট আগ্রহ থাকার পরও।
কলেজের পাট চুকে যাবার পর সাহিত্যের দিকে মনোনিবেশ করেন তিনি। প্রতিবেশীর বাড়িতে আয়োজিত সাহিত্যসভাকে বলা যায় তাঁর অনুপ্রেরণা উৎস হিসেবে। একে একে তিনি লেখেন ‘বড়দিদি(১৯১৩)’, ‘দেবদাস(১৯১৭)’, ‘চন্দ্রনাথ(১৯১৬)’, ‘শুভদা’ ইত্যাদি উপন্যাস, রচনা করেন ‘অনুপমার প্রেম’, ‘বোঝা’, ‘আলো ছায়া’, ‘হরিচরণ’ নামক গল্পসমূহ।
১৯০৩ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি ভাগ্যান্বেষণে রেঙ্গুনে যান। প্রথমে বার্মা রেলওয়ের অডিট অফিসে একটি অস্থায়ী চাকরির ব্যবস্থা হলেও দুবছরের মাথায় তা চলে যায়। এরপর ১৯০৬ সাল থেকে পরবর্তী দশ বছর বার্মার পাবলিক ওয়ার্কস অ্যাকাউন্টস অফিসে চাকরি করেন। কিন্তু একপর্যায়ে বনিবনা না হওয়ায় সে চাকরি ছেড়ে চলে আসেন। বার্মাতে চাকরিকালীন শান্তি দেবী নামে এক ব্রাহ্মণ মিস্ত্রির কন্যাকে বিয়ে করেন। তাঁদের একজন পুত্র সন্তানও ছিলো। কিন্তু রেঙ্গুনের প্লেগে আক্রান্ত হয়ে স্ত্রী পুত্র দুজনেরই মৃত্যু ঘটে। তাঁদের মৃত্যুর অনেককাল পর কন্যার পিতার অনুরোধে তিনি হিরন্ময়ী দেবী নামে এক কিশোরীকে বিয়ে করেন।
বাংলা ১৩১৯ বঙ্গাব্দে ‘যমুনা’ পত্রিকার ফাল্গুন ও চৈত্র সংখ্যায় তাঁর ‘রামের সুমতি’ গল্পটি প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে ‘যমুনা ‘পত্রিকার সম্পাদক তাঁর ‘বড়দিদি’ উপন্যাসটি বই আকারে প্রকাশ করেন। কখনো কখনো পত্রপত্রিকাগুলোতে তিনি ‘অনীলা দেবী’ ছদ্মনামে লিখতেন। উল্লেখ্য,অনীলা দেবী ছিলেন তার দিদি।
প্রকৃতপক্ষে তাঁর সাহিত্য প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটে মধ্যবয়সে এসে। শরৎচন্দ্র তাঁর লেখনিতে সহজ সাবলীল ভাষায় বাঙালির গভীরতর জীবনবোধকে তুলে ধরেছিলেন, যে কারণে তিনি ছিলেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। তিনি কলমের মাধ্যমে ফুটিয়ে ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের নারীসমাজের চিত্র এবং গ্রামবাংলার চিরায়ত রূপ। তাঁর মতো পাঠকনন্দিত কথাসাহিত্যিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আজ অবধি আর পাওয়া যায়নি।
শরৎচন্দ্র কেবল গায়ক, বাদক, অভিনেতা ও চিকিৎসকই ছিলেন না, মনেপ্রাণে তিনি ছিলেন একজন দরদী মানুষ। মানুষের, এমন কি জীবজন্তুর দুঃখ-দুর্দশা দেখলে বা তাদের দুঃখের কাহিনী শুনলে, তিনি অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়তেন। অনেক সময় এজন্য তাঁর চোখ দিয়ে জলও গড়িয়ে পড়ত। তিনি বরাবরই ছিলেন আত্মপ্রচারে বিমুখ।
তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলো হলো ‘বিন্দুর ছেলে'(১৯১৪), ‘বিরাজবৌ'(১৯১৪), ‘পল্লীসমাজ'(১৯১৬), ‘শ্রীকান্ত’, ‘বৈকুণ্ঠের উইল'(১৯১৬), ‘অরক্ষণীয়া'(১৯১৬), ‘পথের দাবী'(১৯২৬), ‘দত্তা'(১৯১৮), ‘দেনাপাওনা'(১৯২৩), ‘চরিত্রহীন'(১৯১৭), ‘গৃহদাহ'(১৯২০), ‘শেষ প্রশ্ন'(১৯৩১) প্রভৃতি। তাঁর রচিত গল্পসমূহ হলো,’মেজদিদি'(১৯১৫), ‘বিলাসী'(১৯২০), ‘মহেশ'(১৯২৬), ‘অভাগীর স্বর্গ'(১৯২৬), ‘অনুরাধা'(১৯৩৪), ‘সতী'(১৯০৪) ইত্যাদি। নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘ষোড়শী'(১৯২৮), ‘বিজয়া(১৯২৮)’, ‘রমা'(১৯০৫) ইত্যাদি। ‘নারীর মূল্য’, ‘তরুণের বিদ্রোহ’, ‘স্মৃতিকথা’, ‘সাহিত্য ও নীতি’, ‘স্বরাজ সাধনায় নারী’, ‘অভিনন্দন’ তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থ।
তাঁর সাহিত্য-কর্মকে ঘিরে ভারতীয় উপমহাদেশে এ পর্যন্ত প্রায় পঞ্চাশটি চলচ্চিত্র বিভিন্ন ভাষায় চিত্রায়িত হয়েছে।এর মধ্যে ‘দেবদাস’ উপন্যাসটি থেকে বাংলা, হিন্দি এবং তেলেগু ভাষায় আটবার চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। ‘স্বামী’ (১৯৭৭) চলচ্চিত্রের জন্য ফিল্মফেয়ার সেরা লেখকের পুরস্কার পান। সাহিত্য প্রতিভার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত জগত্তারিণী স্বর্ণপদকে ভূষিত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পান সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধি। রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও শরৎচন্দ্রের বেশ পদচারণা ছিলো। তিনি ১৯২১ সালে কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন এবং হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতিও নির্বাচিত হন।
জীবনের শেষ প্রান্তে তাঁর শরীর ভালো যায়নি তেমনটা।চিকিৎসকের পরামর্শে দেওঘরেও কিছদিন কাটিয়ে আসেন বায়ু পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে। কিছুদিন পরই তাঁর যকৃতের ক্যান্সার ধরা পড়ে। মৃত্যুর চারদিন আগে তাঁর অপারেশন করেন এক প্রখ্যাত সার্জন। কিন্তু তাঁকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি তিনি মাত্র ৬১ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
শরৎচন্দ্রের মৃত্যুর পর কবিগুরু লিখেছিলেন, “যাহার অমর স্থান প্রেমের আসনে। ক্ষতি তার ক্ষতি নয় মৃত্যুর শাসনে। দেশের মাটির থেকে নিল যারে হরি দেশের হৃদয় তারে রাখিয়াছে বরি।” শরৎচন্দ্রের দৈহিক বিদায় ঘটেছে সত্য,কিন্তু তিনি বেঁচে আছেন অক্ষত অবস্থায় আজো বাঙালির মনেপ্রাণে। আজ এ মহান সাহিত্যিকের জন্মদিনে তাঁর প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।