একটি নির্দিষ্ট জাতি বা গোষ্ঠীর কর্তৃত্ব বিস্তারের লড়াই এবং একই সাথে আরেক জাতির অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই – এমন হাজারো সংগ্রামের ঘটনা দিয়েই তৈরি হয়েছে বর্তমান পৃথিবীর ইতিহাস। পারস্য সভ্যতার ইতিহাসের এমনই একটি ঘটনা হলো ‘তুরের যুদ্ধ’ বা ‘পোয়টিয়ার্সের যুদ্ধ’ যা বর্তমান পারস্যের ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবকাঠামোর ভিত তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে।
তুরের যুদ্ধের এক পক্ষ ছিলো উমাইয়া খলিফা ও কর্ডোবার গভর্নর, আব্দুল আল- রহমানের মুসলমান সৈন্য আর অপর পক্ষ ছিল পশ্চিম ইউরোপের মেরোভিঞ্জিয়ান ফ্রাঙ্ক রাজ্যের শাসক চার্লস মার্শালের খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী সৈন্যরা। ৭৩২ সালের আজকের এই দিনে সংঘটিত হওয়া তুরের যুদ্ধে চার্লসের জয়ে স্পেন থেকে বহিরাগত উমাইয়া খলিফার সৈন্যরা পিছু হঠে । সেজন্যই এ যুদ্ধের ঠিক একশ বছর আগে অর্থাৎ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর মৃত্যুর পর পৃথিবী জুড়ে শুরু হওয়া ইসলামের বিস্তারের অসাধারণ গতি পশ্চিম ইউরোপে এসে হোঁচট খায়।
উমাইয়া খলিফারা শ্রেষ্ঠ চারটি ইসলামিক রাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠার পর, ৭ম শতাব্দীতে রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যের উপর কর্তৃত্ব বিস্তারের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। ৭১১ খ্রিস্টাব্দে মাগরেবের উমাইয়া গভর্নর মুসা ইবন নাসের সেনাবাহিনী মোতায়েন করেন। ওই বছরেই তৎকালীন আইবেরিয়ার ক্যাথলিক রাজ্য, বর্তমান স্পেন ও পর্তুগাল দখল করে উমাইয়া খলিফা।
মুসলিম সেনাবাহিনী ৭২০ সালের মধ্যেই বর্তমান পশ্চিম ফ্রান্সে এবং ৭২৫ সালের মধ্যে বারগান্ডির মাটিতে পা রাখতে পেরেছিল। ৭৩১ সালে পাইরিনির উত্তরে উমাইয়া খলিফা আব্দুল আল-রহমান উত্তর আফ্রিকার সাহায্য নিয়ে আরো শক্তিশালী হন এবং গৌলে একটি বড়সড় পদক্ষেপের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। অ্যাকুইটাইনের ডিউক ওডুর অস্তিত্ব হুমকির আভাস দিচ্ছিল। তাই ৭৩২ সালে উমাইয়া খলিফা অ্যাকুইটাইন আক্রমণের মাধ্যমে শুরু করেন তাঁর অভিযান।
সে যুদ্ধে ডিউক ওডু পরাজিত হন। এদিকে খলিফার সেনাবাহিনী অ্যাকুইটাইনের রাজধানী বোর্দো পুড়িয়ে দেয়। তবে ওডু তার অবশিষ্ট সৈন্যদের নিয়ে ফ্রাঙ্কে (বর্তমান ফরাসি রাজ্যে) পালিয়ে যান, “হাতুরি” নামে খ্যাত অস্ট্রাসিয়ার ফ্রাঙ্ক রাজ্যের মেয়র চার্লস মার্শালের সাহায্য পেতে।
যুদ্ধের বিস্তারিত বর্ণনা এমনকি সঠিক স্থান চিহ্নিত করা না গেলেও নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে বলা হয়ে থাকে যে, তুর ও পোয়েটার্সের মাঝামাঝি কোথাও যুদ্ধটি হয়েছিলো। ওডুর প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে চার্লস তাঁর সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি করেন ও অশ্বারোহী নিয়ে তুর শহরে পৌঁছান। চার্লস অপেক্ষা করতে থাকেন আল-রহমানের বাহিনীর জন্য। এদিকে সৈন্যদের অস্থিরতা ও আবহাওয়াসহ নানাবিধ কারণে মুসলিম অশ্বারোহীরা প্রথমে আক্রমণ করতে বাধ্য হন।
চার্লসের বাহিনীর তুলনায় আল-রহমানের বাহিনী কয়েকগুণ বড় হওয়া সত্ত্বেও অভিজ্ঞ ও চৌকস পদাতিক বাহিনীদের নিয়ে চার্লসের সেনাবাহিনী অনেক সুবিধার মধ্যেই ছিলো। কিন্তু যুদ্ধের ফলাফল চূড়ান্ত হয়ে যায় যখন মুসলিম উমাইয়া বাহিনীর পেছন দিক থেকে আক্রমণ করে ওডুর অ্যাকুইটানিয় অশ্বারোহী বাহিনী। একারণে অনেক উমাইয়া সৈন্য দ্বিধান্বিত হয়ে যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যান।
তবে সারাদিন ধরে চলা যুদ্ধে খলিফা আব্দুল আল-রহমান প্রচন্ড সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনিসহ আরো প্রায় ২৫ হাজার সৈন্য শহীদ হন। পরবর্তীতে সেই রাতেই আরেক উমাইয়া সেনাপতি বাকি সৈন্যদের নিয়েও পিছু হঠেন বলে জানা যায়। ফলে যুদ্ধ শেষ হয়ে যায় এবং ফরাসিদের জয় হয়।
ইতিহাসবেত্তাগণের মতে, ফরাসিদের জয়টা অবধারিত হয়ে ওঠার পেছনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপট হলো- আব্দুল আল-রহমানের অ্যাকুইটাইনে আক্রমণের ধরণটা সত্যিকারের দেশ বা অঞ্চল জয় করার মতো নয়, বরং বিশাল একটা অভিযানের মতো ছিলো। উমাইয়া সেনাবাহিনী বোর্দোকে লুট করলেও দখলের কোনও চেষ্টা করেনি, এমনকি পোয়টিয়ার্সকে পর্যন্ত পাশ কাটিয়ে চলে যায়।
তবে পশ্চিম ইউরোপে মুসলমানদের অগ্রযাত্রা থেমে যাওয়ার পেছনে রয়েছে উত্তর আফ্রিকার বর্বরজাতির বিদ্রোহ (৭৩৯ সাল) এবং মুসলিম কর্তৃত্বের অভ্যন্তরীণ কোন্দল। তুরের যুদ্ধ আসলে মুসলমানদের পারস্য আক্রমণ ও সীমান্তে মুসলমান-ফ্রাঙ্কিশ বিরোধকেও ত্বরান্বিত করেছিল। কারণ পরবর্তী দুই বছরে আল-আন্দালাসের (মুসলিম স্পেন) গভর্নর উকবা ইবনে আল-এজাজ ও সেপ্টিমানিয়ার নার্বোনের গভর্নর ইউসুফ অ্যাকুইটাইন আক্রমণ করেন এবং ইউসুফ সেখানে ঘাঁটি গড়তে সক্ষম হন।
যাইহোক, তুরের এই যুদ্ধের পর ফরাসি রাজত্বে চার্লস মার্শালের বংশধররা ক্যারোলিনজিয়ান হিসেবে শাসন চালিয়ে যায়। রোমান সাম্রাজ্যের ভূখণ্ডে ইসলামিক অগ্রযাত্রার অদম্য প্রকৃতির কারণে খ্রিস্টানদের পরাজয় প্রায় অনিবার্য বলে মনে হয়েছিল তুর যুদ্ধের সময়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ ইউরোপ পাড়ি দিয়ে মুসলিম সৈন্যদের এই যাত্রা পশ্চিম ইউরোপে এসে থামে। মজার বিষয় হলো ঐতিহাসিক ও গবেষকরা এখনো বিস্মিত হন এই ভেবে যে, যদি মুসলিম সৈন্যদের এই যাত্রা তুরের যুদ্ধে না থামতো, তবে এই পৃথিবীর অস্তিত্বের লড়াইয়ের ইতিহাস কতোটা নাটকীয়ভাবেই না পরিবর্তিত হয়ে যেত!